বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৩ পূর্বাহ্ন
তরফ নিউজ ডেস্ক: সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের মৃত্যুতে কাঁদছে নগরবাসী। এ নগরের মানুষের সুখে-দুঃখে তিনি ছিলেন এক অদ্বিতীয় সঙ্গী। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে অসহায় হয়ে পড়া মানুষের জন্য মানবিক হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন কামরান।
এই দুর্দিনে তিনি করোনায় সংক্রমিত হতে পারেন জেনেও অসহায় মানুষদের বাড়িতে নিজে খাদ্যসামগ্রী বহন করে নিয়ে গেছেন। অবশেষে করোনায় আক্রান্ত হয়ে সোমবার ভোরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) মারা গেছেন প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ।
বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় কামরানকে লক্ষ্য করে দুই দফা গ্রেনেড হামলা করে জঙ্গিরা। দুই দফাতেই অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেলেও তাকে করোনাভাইরাসের কাছে হার মানতে হলো।
সিলেট পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা হয় ২০০২ সালের ২৮ জুলাই। বিলুপ্ত পৌরসভার চেয়ারম্যান বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে নবগঠিত সিলেট সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র করা হয়। এর পর ২০০৩ সালের ২০ মার্চের নির্বাচনে তিনি আনারস প্রতীক নিয়ে তৎকালীন সরকারি দল বিএনপির প্রার্থী এমএ হককে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সিলেটের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৭৩ সালে সিলেট পৌরসভার সর্বকনিষ্ঠ কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিলেন কামরান।
ওয়ান ইলেভেনের সময় জেলে থেকেও কামরান বিএনপির প্রার্থী বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা এম এ হককে ফের পরাজিত করে এক লাখ ভোটের ব্যবধানে দ্বিতীয় বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে হেরে যান তিনি। এরপর ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনেও আরিফের কাছে হেরে যান কামরান। কিন্তু এরপরও তিনি নগরবাসীর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। এ নগরের মানুষের সুখে-দুঃখে তিনি পাশে ছিলেন।
ষাটের দশকে ছাত্রলীগে যোগ দেওয়া এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ ১৯৭৩ সালে যখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র তখন শুরু হয় দেশের প্রথম পৌর নির্বাচন। এ সময় তিনি সিলেট পৌরসভায় ৬৪৪টি ভোট পেয়ে তোপখানা ওয়ার্ডের কমিশনার নির্বাচিত হন। সে সময় সিলেট শহরে মাত্র ৫টি ওয়ার্ড ছিল। তোপখানা ছিল ৩নং ওয়ার্ডের অধীন। এরপর ১৯৭৭ সালে আবার নির্বাচন হলো। কমিশনার নির্বাচিত হলেন তিনি।
তারপর কিছু দিনের জন্য দেশের বাইরে চলে গেলেন কামরান। দেশে এসে ১৯৮৯ সালে আবারও নির্বাচনে অংশ নিলেন। তখনও তিনি একই ওয়ার্ড থেকে কমিশনার নির্বাচিত হন। তখন তার প্রতীক ছিল আনারস।
সেই সাফল্যের পথ ধরে এভাবে ১৯৯৫ সালে তিনি পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। নিজ দল ক্ষমতার বাইরে থাকা অবস্থায় অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি দুইবার মেয়র পদে নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়েন। কিন্তু ২০১৩ সালে নিজ দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বিরোধী দলের প্রার্থীর কাছে পরাজয় মেনে নিতে হলো সাবেক জনপ্রিয় এই মেয়রকে।
একটানা কয়েক বছর ক্ষমতার ধারাবাহিকতায় আকস্মিক এই হোঁচটকে তবুও ব্যক্তি কামরানের পরাজয় বলে দেখেননি সিলেটের কামরান অনুরাগীরা। তারা মনে করতেন, সিলেটের বৃহত্তর স্বার্থে অতীতের সকল অভিজ্ঞতা নিয়ে নবনির্বাচিত মেয়রকে সহযোগিতা করবেন সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান।
সিলেট সিটি করপোরেশন উন্নীত হওয়ার পর ২০০২ সালের ২৮ জুলাই তিনি ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৩ সালের ২০ মার্চ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। ওয়ান ইলেভেনের পর ২০০৭ সালের ৬ এপ্রিল গ্রেফতার হন কামরান। এক মাস কারাভোগের পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। এরপর ২৮ মে তিনি আবার গ্রেফতার হন। ওই মাসে কারান্তরীণ হন তিনি।
কারাগারে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট তাকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়। নির্বাচনী প্রচারণার জন্য তাকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার কথা শোনা গেলেও পরে তা হয়নি। অবশেষে তার নির্বাচন পরিচালনার জন্য গঠিত হয় ৫০১ সদস্য বিশিষ্ট নাগরিক পরিষদ। কারাগারে থেকে ২০০৮ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র নির্বাচিত হয়ে তিনি আবারও ইতিহাস গড়েন। তখন তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে ৮৩ হাজার ৩৩৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। সে সময় মেয়র কামরান সবমিলিয়ে ১ লাখ ১৫ হাজার ৪৩৬ ভোট পান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আ ফ ম কামাল ৩২ হাজার ৯৭ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন।
বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ১৯৬৮ সালে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি দীর্ঘদিন সিলেট শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি পদে ছিলেন।
সর্বশেষ ২০১৯ সালের ত্রিবার্ষিক কাউন্সিলে কামরানকে বাদ দিয়ে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয় মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদকে। আর কামরানকে করা হয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। এর আগের মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির পাশাপাশি দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন কামরান।